Thursday 10 November 2016

কাশ্মির ভ্রমন

কাশ্মির ভ্রমনের ইচ্ছা আর সবার মত আমারো ছিল। অনেক দিন ধরে ইচ্ছাটাপুষিয়ে রেখেছিলাম। সবাই কে দেখতাম বিভিন্ন টুর প্যাকেজ এ করে কাশ্মির ভ্রমনে যায়। কিন্তু তাদের খরচের কথা শুনার পর কখনোই কাশ্মির ভ্রমনের দু:সাহস করি নাই। কিছুদিন আগে জীবনের প্রথম ইন্ডিয়ান ভিসা সিল পাওয়ার পর ভাবলাম যাই ইন্ডিয়ে ঘুরে দেখে আসি। যেহেতু সল্প বেতনের চাকরি করি। খুজতে থাকলাম ১৬-১৭ হাজার এ কোথায় ঘুরে আসা যায় ভারতের। সবাই বল্ল এই বাজেটে দার্জিলিং ছাড়া কোথায় নাকি ঘুরতে পারব না। যাই হোক নিজের দৃড় ইচ্ছা আর TOB help line এর সহায়ায়তায় কাশ্মির এর ব্যাপারে অনেক খুটিনাটি তথ্য নেওয়া শুরু করলাম। অনেক ভেবে দেখলাম কাশ্মির ২০ হাজার টাকাতেই ঘুরে আসা সম্ভব।
আর মিথ্যা বলবনা। সত্যিই আমি ১৮০০০ টাকা নিয়ে কাশ্মির এর উদ্দেশ্যে বেড়িয়েছিলাম আর দেশে ফেরত এসেছি ৪০ রুপি নিয়ে। আরেকটু খুলে বলি। কাশ্মির এ আমার হোটেল ভাড়া+ a-z ট্রান্সপোর্ট এ ৮০০০ বাংলাদেশি টাকা খরচ। বাকি ১০০০০ টাকা আমারর টোটাল জার্নির খাওয়া, শপিং টিকেট খরচ এ হইসে। আজকে আমার এই পোস্টে আমার সেই কম খরচে কাশ্মির টুরের গল্ম শুনাব সবাইকে।


কাশ্মির টুরের প্রস্তুতি শুরু হয় আমার ঢাকা থেকেই, হাওড়া টু কাশ্মির আপ -ডাউন টিকেট কেনার মধ্য দিয়ে। ১ মাস আগে টিকেট করেছিলাম। হিমগিরি এক্সপ্রেসে হাওড়া টু জাম্মু যাওয়া আসা আমার টিকেটে খরছ হয়েছিল ৭৫০+৭৫০=১৪০০ রুপি। বাংলা টাকায় ২২০০ পড়েছিল। sleeper class. 
২৩ নভেম্বর সন্ধ্যা ৭টার চিত্রা এক্সপ্রেস ট্রেনে প্রথমে যশোর যাই। ট্রেন ভাড়া ৪৬০ টাকা। যশোর নামিয়ে দেয় ভোর ৪ টায়। ট্রেন থেকে যশো নেমে স্টেশনের বাইরে থেকেই বাস পেয়ে যাই বেনাপোল বর্ডারের। ভাড়া ৫০ টাকা। 
২৪ তারিখ ভোর ৬ টার মধ্যে বর্ডার পৌছাই। আর কোন প্রকার দালালের সহায়তা ছাড়াই সাড়ে ৬ টার মধ্যে ভারতিয় সীমানায় প্রবেশ করি। বর্ডার ক্রস করে চা খেয়ে নিলাম। তার পর অটোরিক্সায় ৩০ রুপি ভাড়ায় লোকালে চলে এলাম বনগা স্টেষন। ১০ রুপি দিয়ে বনগা থেকে গেলাম দমদম স্টেশন। আমি চাইলে সরাসরি শিয়ালদহ স্টেশনে আসতে পারতাম। কিন্তু খুব ইচ্ছা ছিল কোল্কাতার মেট্রো রেল ভ্রমনের। যাইহোক দমদম নেমে চলে গেলাম মেট্রোরেল স্টেশনে। ১০ রুপি টিকেট কাটলাম দমদম থেকে এসপ্লেনেট। ১৫ মিনিট এ পোছে গেলাম এসপ্লেনেট। এসপ্লেনেট এ মেট্রোরেল থেকে নেমেই রাস্তা ক্রস করেই কোল্কাতা নিউ মার্কেট। 
যেহেতু রাত ১২ টা তে আমার ট্রেন। আর পকেটেও টাকা কম। তার আর হোটেল নিলাম না। ইচ্ছা ছিল সারাদিন কোল্কাতা শহর ঘুরে দেখে একবারে রাতে ট্রেন ধরব সরাসরি। যাইহোক কোলকাতা পৌছে প্রথমত সব টাকা ডলার রুপিতে কনভার্ট করলাম। আর ৩৪০ রুপি দিয়ে একটা এয়ারটেল সিম কিনে নিলাম। সারাদিন কোল্কাতা ঘুরলাম। আমি যেহেতু স্ট্রিট সিংগিং করি। কোলকাতার বেশ কয়েকটি স্থানে আম রাস্তায় গান করেছিলাম। কোলকাতার মানুষ বাংলা গানের অনেক কদর করে। অনেক স্রদ্ধ্যা ভালোবাসা পেয়েছি সেখানে। ইভেন এক ছেলে আমাকে তার বাইকে করে কোলকাতা শহর ঘুরে বেরানোর প্রস্তাব দেয়। এত সুন্দর অফার সাথে সাথেই লুফে নিলাম। ছেলেটা নিজের খরচে আমাকে ইডেন গার্ডেন, ভিক্টোরিয়া মেমরিয়াল, হাওড়া ব্রিজ সহ অনেক প্লেসে ঘুরিয়ে নিয়ে আসে। কাশ্মির টুরের জন্যে প্রয়জনিয় জিনিস পত্র সব ঢাকা থেকেই কিনে নিয়ে গেছিলাম। তাই শপিং এ সময় না দিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে স্ট্রিট সিংগিং করে আর রাস্তার পাশের খাবার খেয়েই সময় পার হয়ে গেছিল। রাত ১১ টার মধ্যে হাওড়া স্টেশনে পৌছলাম। রাত ১২ টায় যথা সময়ে ট্রেন ছেড়ে যায়।
২৫ তারিখ ঘুম ভাংগে ট্রেনের মধ্যে। নন এসি স্লিপার এর বাংকার খারাপ না। এটলিস্ট আমার মত যারা কষ্ট করে ভ্রমন করতে পারেব তাদের খারাপ লাগবেনা। ট্রেনে খাওয়া দাওয়া সস্তা আছে। কিন্তু খাবার বেশি মজার নয়। ডিনার /লাঞ্চ এ আমার ৬০ রুপি আর নাস্তায় আমার ৩০ রুপি করে খরচ হয়েছিল। 
দীর্ঘ ৪৬ ঘন্টা জার্নির পর ২৬ তারিখ রাত ১০ টায় জাম্মু তাওয়াই স্টেশনে নামি। স্টেশনে নেমে হালকা খেয়ে আবার বাস নিয়ে রোউনা দেই শ্রীনগরের উদ্দেশে। রাত ১২ টায় বাসে উঠি আর শ্রীনগরে পৌছাই সকাল ৮ টায়। পুরো রাস্তা অনেক সুন্দর ছিল কিন্তু অনেক রাত হওয়াতে তেমন কিছু দেখতে পারি নাই। পথে অনেক গুলো ট্যানেল পড়েছিল। কয়েকটা ছিল ৬-৭ কিমি লম্বা। 
২৭ তারিখ শ্রীনগরের আসে পাশে ঘুরে দেখি। ডাল লেক এ শিকারা রাইড করি। শিকারা বোটের খরচ ৩০০-৪০০ রুপি ৪ জন উঠা যায়। 

ঠান্ডায় শ্রীনগরর আসলে দেখার মত তেমন কিছু নাই। তবে কয়েকটা পার্ক এ গিয়েছিলাম। পার্ক গুলা মেপল লিফ এ ভরা ছিল। পার্কের বেশ কিছু ছবিও দিয়েছি। শ্রিনগরে খাবার এর মান অনেক ভালো। এখানে আসলে অবশ্যই আপনি এখানকার কাবার আইটেল গুলা ট্রাই করে দেখবেন। ১৫০ রুপি এর মধ্যে ভরপুর লাঞ্চ বা ডিনার করতে পারবেন। কেনাকাটা যা করার শ্রিনগর থেকেই সেরে নিন কারন অন্য প্লেসে এত দোকান পাবেন না।
২৮ তারিখ গেছিলাম গুল্মার্গ। গুল্মার্গ এ গেলে অনেকেই আপনাকে বলবে ঘোড়া নেওয়ার জন্যে খরচ ও কম চায়না। একেকজন একেদাম বলে কনফিউসড করবে। তার পরেও কম পক্ষে ঘোড়ায় ৫-৬শ রুপি খরচ হবে। তবে আমি মনে করি যদি আপনার ভালো জুতা আর শারিরিক শক্তি থাকে আপনি সহজেই হেটে গুল্মার্গ এর সব গুলা টুরিস্ট প্লেস গুলা ঘুরে দেখতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সকাল সকাল আপনাকে গুল্মার্গ এ পৌছাতে হবে। গুলমার্গ এ গেলে অবশ্যই কেবল কারে চড়বেন। কেবল কারে করে ৮০০০ ফিট উঠ তে খরচ হবে ৭০০ রুপি ১৪০০০ ফিট উপরে উপরর গেলে ১৬০০ রুপি। উপরে উঠে ধুমপান/ মধ্যপান / দৌড়া দৌড়ি না করাই ভালো। এতে আপনার অসুস্থ হওয়ার অনেক সম্ভবনা থাকবে।
গুলমার্গ এ রাতে থাকতে চাইলে আপনার রুপ প্রতি ১২০০ রুপি থেকে ৫০০০ রুপি খরচ হবে। খাওয়া দাওয়া ১৫০ রুপিতে লাঞ্চ/ ডিনার। ১০০ রুপিতে ব্রেকফাস্ট। 
২৯ আর ৩০ দুই দিন থেকেছিলাম প্যাহেল্গাম এ। পেহেল্গাম এডভেঞ্চার প্রিয় আর ট্রেকারদের জন্যে স্বর্গস্থান। এখানে আপনি ট্রেক করার জন্যে টুলিয়ান লেক, তারসার-মারসার, শিষনাগ সহ আরো অনেক প্লেস পাবেন। তবে রিলাক্সলি ঘুরে দেখতে চাইলে আরু ভেলি, বেতাব ভেলি, বাইসারান ইত্যাদি প্লেস গুলা ঘুরে দেখতে পারেন। আরু ভ্যালি এর পার্ট টায় যেতে গাড়ি লাগবে। বাইসারান এর দিকে গেলে ঘোড়া বা হেটেও যেতে পারবেন। পেহেল্গামে শপিং করার তেমন দোকান পেলাম না। তবে স্ট্রিট ফুড পাবেন অনেক। পেহেলগামে থাকতে খরচ হবে ৬০০- ৫০০০ রুপির মত। 
যদি আমাকে জিজ্ঞাস করা হয় কোন সময় কাশ্মির ভ্রমনের জন্যে সবচেয়ে উপযুক্ত তাহলে বলব কাশ্মীর সব সময় ই সুন্দর। একেক সময় একেক রঙ।আমি যে সময়টাতে গেছিলাম আমি মুলত ৩ টা কালার পেয়েছি। লাল, সাদা আর সবুজ। তবে অতিরিক্ত শীতের জন্যে আমি জানুয়ারি ফেব্রুয়ারিতে কাশ্মির যেতে কিছু টা নিরুতসাহি করব। 
ফিরে আসার দিন আমি সরাসরি পেহেলগাম থেকে জাম্মু চলে আসি। কিন্তু আসার দিন আমার পুর্ব নির্ধারিত ট্রেন কেন্সেল হয়ে যাওয়ায় আমার দুর্বিষহ যাতনায় পড়তে হয়েছিল। পকেটেকে টাকাও প্রায় ফুরিয়ে এসেছিল।আমার মনে পড়ে আমি যখন ফেরার টাইমে উত্তর প্রদেশে ছিলাম আমার শেষ সম্বল ছিল মাত্র ১৩০ রুপি। যাই হোক সৃষ্টি কর্তার অসিম কৃপায় আর ট্রেনে সহযাত্রিদের সহায়তায় আমি নিরাপদে বেনাপোল বর্ডার ক্রস করি। অইখানে এসে মাকে বলি বিকাশ করতে। ওই বিকাশের টাকা দিয়ে অবশেষে বাড়ি ফিরে আসি। 
কিছু বিষয় আপনাদের বলে রাখি। 
১. কাশ্মিরে একমাত্র কেবল কার ছাড়া কোন প্রাইস ই সরকার নির্ধারিত নয়। সো একদম গুলিস্তান স্টাইলে দরদার করবেন।
২. সবপ্লেসেই যাওয়ার জন্যে শেয়ার বাস গাড়ি পাবেন। তাই যারা একা টুর দিতে চাচ্ছেন নির্ভয়ে চলে যান। রিজার্ভ গাড়ি ভাড়া দিন প্রতি ২০০০-৩৫০০ পর্যন্ত আছে। 
৩. স্থানিয় ব্যাবসায়ি, দোকানদার, এদের সাথে অবশ্যই হিন্দি আর উর্দু তে কথা বলবেন। 
আর বি এস এফ পুলিশ ধরলে ধুমায়ে ইংলিশ বলবেন  খিক খিক খিক
৪. ডাল লেকে শপিং না করে শ্রিনগরে কেনাকাটা করবেন।
৫. কোন প্লেস এ ছবি তোলার আগে বা ওপেনলি স্মোক করার আগে জেনে নিবেন 
আমি যখন কাশ্মির গিয়েছিলাম প্রায় প্রতিদিন এ মাইনাস ডিগ্রি তাপমাত্রা ছিল। কখনো কখনো মাইনাস ৬-৭ ও পেয়েছি। এই শীত থেকে বাচতে আমি যা যা পড়েছিলাম
১. এক্সট্রা ইনার সহ স্নো বুট। 
২. সিন্থেটিক ইনার
৩. লাক্স বডি ওয়ার্মার ( থার্মাল)
৪.উলের ফুলহাতা টিশার্ট
৫. মোটা উলের সোয়েটার
৬. রেইন কোট
নিচে 
৭. সিন্থেটিক ইনার প্যান্ট
৮. ফ্লিস এর পায়জামা
৯. গ্যাবার্ডিং প্যান্ট
আমার এই টুরে গিয়ে আমার ভারতীয় দের ব্যাপারে ধারনা একদম পালটে গেছে। 
ভারতীয় লোকজন অনেক ভালো। অনেক হেল্পফুল আর মিশুক। আমি আমার পুরা জার্নিতে এত এত বন্ধু আর এত ভালোবাসা পেয়েছি। আমার সারাজীবন মনে থাকবে। গান বাজনা করি। স্ট্রিট সিংগিং করি এই সুবাদে অনেক সুবিধা পেয়েছি। অনেক প্লেসে আমার খাওয়ার কোন খরচ লাগে নাই। স্থানিয়রাই আমাকে খাইয়েছে। আমি কাশ্মির এ কয়েকজন স্থানিয় লোকের বাসায় গেছিলাম। অনেক ভালোবাসা পেয়েছি। স্পেশালি ওদের বি এস এফ সদস্যরা অনেক আন্তরিক। ওদের ভয় পাবেন না। 
অনেক সংক্ষেপে পুরা টুরের হিসাব নিকাশ দেওয়া টা কঠিন ছিল। তার পরেও কারো বিস্তারিত যেকোন তথ্যের জন্যে আমাকে নক করতে পারেন। আমার সাধ্য মত হেল্প করব :)আরেকটা ব্যাপার ১৮-১৯ এ কাশ্মির টুর দেয়া পসিবল তাই বলে ১৮-১৯ হাজার টাকা নিয়ে বের হয়ে যাবেন না কিন্তু। কারন বিপদ বলে কয়ে আসে না। তাই অববশ্যই এক্সট্রা কিছু নিয়ে যাবেন।